OrdinaryITPostAd

ইলিশ আর কত অত্যাচার সহ্য করবে

ইলিশের আর্তনাদ
বাঁশতলা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। প্রতিদিন সকালে সূর্য উঠতেই গ্রামের মানুষদের চোখ পড়ে নদীর ওপর। দূর থেকে তাকালেই দেখা যায় অসংখ্য নৌকা জাল ফেলছে, ইলিশ মাছ ধরার প্রতিযোগিতা যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইলিশ, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, গ্রামবাসীর প্রিয় ও আর্থিক ভরসা। কিন্তু ইলিশের মনে এক গভীর আতঙ্ক কাজ করছে—আর কতদিন সে বাঁচতে পারবে?
ইলিশ আর কত অত্যাচার সহ্য করবে



পদ্মার এক নির্জন স্থানে একটি ছোট ইলিশের দল পানির নিচে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। দলের প্রধান, এক বৃদ্ধ ইলিশ, ভাবুক চোখে তাকিয়ে আছে মানুষের নৌকাগুলোর দিকে। তার কণ্ঠে বিষাদের ছোঁয়া, "কতকাল আগে এই নদীতে আমরা কত আনন্দে ভেসে বেড়াতাম। কেউ আমাদের ধাওয়া করত না। আর এখন, মানুষের অত্যাচারে আমরা কোথাও নিরাপদ নই।"

এক তরুণ ইলিশ প্রশ্ন করল, "কিন্তু আমরা তো মানুষেরও উপকার করি, তারা আমাদের ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এটা কি অন্যায়?"

বৃদ্ধ ইলিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, "সেটা অন্যায় নয়, কিন্তু মানুষের লোভ যখন মাত্রা ছাড়ায়, তখন তা অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়। আগে তারা আমাদের প্রজননকালে ছেড়ে দিত, নদীর গভীর অংশগুলো আমাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ছিল। কিন্তু এখন? মানুষ নদী দখল করেছে, প্রজননের সময়ও শান্তি নেই।"

এমন সময় একটি তরুণী ইলিশ তাদের আলোচনায় যোগ দিয়ে বলল, "মানুষ এখন আমাদের জন্য প্রকল্প করছে, ইলিশ সংরক্ষণ এবং মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করছে। এগুলো কি আমাদের সাহায্য করবে না?"

বৃদ্ধ ইলিশ মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ, কিছু প্রকল্প হয়েছে। ইলিশের প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণে অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়েছে, যেখানে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। তবে সেই এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো হয় না। জেলেরা রাতের আঁধারে এসে জাল ফেলে দেয়, এমনকি আমাদের ডিম দেওয়ার মৌসুমেও। আর যেসব নদী দিয়ে আমরা সমুদ্রে যাই, সেখানেও নানা বাঁধ, শিল্প বর্জ্য, আর প্লাস্টিকের দূষণ আমাদের চলাচল কঠিন করে তুলছে।"

একটি মাঝারি বয়সী ইলিশ বিস্মিত হয়ে বলল, "কিন্তু আইন তো আছে! প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ, সেটা মানা হচ্ছে না?"

বৃদ্ধ ইলিশ করুণ হেসে বলল, "মানুষের অনেক আইন আছে, কিন্তু লোভ সেই আইনকে অমান্য করায়। কত জেলেরা আমাদের ধরতে রাতের আঁধারে আসে, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। তাদের জাল এত সূক্ষ্ম যে ছোট মাছও পালানোর উপায় পায় না। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে।"

তরুণ ইলিশের চোখে ভয়, "তাহলে কি আমাদের জন্য কোনো আশা নেই?"

"আশা আছে," বৃদ্ধ ইলিশ গভীর কণ্ঠে বলল, "মানুষ যদি তার দায়িত্ব বোঝে, যদি নদীকে তার মতো থাকতে দেয়, তবে হয়তো আমাদের আবার শান্তিতে বাস করা সম্ভব হবে। কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে দ্রুত শিখতে হবে যে নদী আর তার প্রাণীরাও তাদের জীবনের অংশ। একদিন হয়তো তারা বুঝবে, ইলিশ নেই মানে নদীর প্রাণ নেই, আর নদী নেই মানে মানুষেরও বাঁচার পথ নেই।"

একটি বয়স্ক ইলিশ আরো কিছু তথ্য যোগ করে বলল, "মানুষ জানে, ইলিশ মাছ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভগুলোর একটি। আমাদের রপ্তানি করে তারা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গভীর। কিন্তু লোভের কারণে, তারা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে। ইলিশ কমে গেলে একসময় দেশের মানুষকেও এর মাশুল গুনতে হবে।"

তাদের কথার মধ্যেই হঠাৎ জালের আঘাতে পানিতে আলোড়ন উঠল। ইলিশের দলটি দ্রুত ছুটে পালানোর চেষ্টা করল। কিছু ইলিশ ধরা পড়ল, বাকিরা গভীরে সরে গেল।

ইলিশের দলটি নীরবে সরে গেল পদ্মার গভীরে। কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যেও নদী কাঁপছে। নদীর বুক চিরে চলছে মানুষ আর জেলের নৌকা। মানুষ লোভের বশে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর নদী ও ইলিশের আহাজারি ক্রমশ গুমরে উঠছে পদ্মার স্রোতে।

সেইদিন হয়তো আসবে, যখন মানুষ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাববে—ইলিশ ছিল, কিন্তু এখন নেই। তারপর তখনই তারা বুঝবে যে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে কোনো জাতি টিকে থাকতে পারে না।

গল্পের ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইলিশের সংকট ও সংরক্ষণ নিয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগ করা যেতে পারে যা বাস্তবতার সাথে আরও সম্পর্কিত হবে:

১. ইলিশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

ইলিশ মাছ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর লক্ষাধিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়, যার উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি হয়, আর কিছু অংশ রপ্তানি হয়। ইলিশ রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইলিশ মাছকে ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা ইলিশের আন্তর্জাতিক সুনামকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

২. ইলিশ সংরক্ষণে নেওয়া সরকারি পদক্ষেপ

ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সাধারণত, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার চার দিন আগে ও চার দিন পরে মোট ২২ দিন ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। এছাড়াও ইলিশের প্রধান প্রজনন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত কিছু নদীতে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

সরকার বছরে ৬৫ দিন সামুদ্রিক মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, যাতে ইলিশ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রজাতির মাছের প্রজনন নির্বিঘ্নে হতে পারে। এ সময়ে জেলেদের জন্য বিশেষ ভাতা ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়, যাতে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

৩. দুর্নীতি ও আইনের শিথিল প্রয়োগ

যদিও প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তবুও অনেক জেলেরা রাতের অন্ধকারে গোপনে মাছ ধরার কাজ চালিয়ে যায়। জাল নিষিদ্ধ থাকলেও, সূক্ষ্ম জাল ব্যবহার করে ছোট মাছসহ ডিমওয়ালা মাছ ধরা হয়, যা ইলিশের প্রজনন চক্রকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেকে আইনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয় দুর্নীতির মাধ্যমে।

এছাড়া, প্রজনন মৌসুমে মৎস্য অভয়ারণ্যগুলোতে যথাযথ নজরদারি না থাকায় ইলিশ সংরক্ষণ কার্যকরভাবে হয় না। এই শিথিলতা ভবিষ্যতে ইলিশের প্রজননশীলতা ও সংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ হতে পারে।

৪. নদীর পরিবেশগত বিপর্যয়

ইলিশের জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নদী এবং সাগর উভয়ই প্রয়োজন। ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য নদীতে আসে, আর তাদের ছোট বাচ্চারা সেখান থেকে বড় হয়ে সমুদ্রে চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে নদীগুলোর পরিবেশগত অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। নদীতে জমে থাকা পলিথিন, প্লাস্টিক বর্জ্য, শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এবং অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ইলিশের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো নদীর প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এবং পানি দূষিত করে, যা ইলিশের প্রজনন ও বেঁচে থাকার পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলে।

৫. প্রকৃতির ভারসাম্য ও ইলিশের অস্তিত্ব

ইলিশ বাংলাদেশের পানিসম্পদ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইলিশ কমে গেলে তার প্রভাব শুধু জেলেরা নয়, গোটা দেশকে ভুগতে হবে। কারণ এটি শুধু একটি মাছ নয়, বরং একটি জৈবিক চক্রের অংশ, যা নদী ও সাগরের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। ইলিশ কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন ছোট মাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জলজ প্রতিবেশে প্রভাব ফেলছে।

৬. সম্ভাব্য সমাধান

ইলিশ সংরক্ষণে আরও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন:

জেলের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা: জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। তাদের বিকল্প জীবিকা উৎসের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

বাধ্যতামূলক আইন প্রয়োগ: আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোরতা ও জেলেদের জন্য আর্থিক ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে তারা প্রজনন মৌসুমে আইন ভঙ্গ না করে।

নদী দখল ও দূষণমুক্ত রাখা: নদীর পাশে শিল্পকারখানার বর্জ্য ফেলা ও অনিয়ন্ত্রিত বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করে ইলিশের চলাচল ও প্রজননের স্বাভাবিক পথ তৈরি করা জরুরি।

জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার: ইলিশের প্রজনন ও সংখ্যা বাড়াতে আধুনিক জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলিশের জন্ম এবং বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা যেতে পারে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

কাজীআরিফুল ডট কমে নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url